সংবাদ শিরোনাম: |
❒ ভারতের বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণ
বিচার ব্যবস্থা একটি দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর মূল ভিত্তি। এটি ন্যায়বিচার নিশ্চিত করে, আইনের শাসন বজায় রাখে এবং নাগরিকদের অধিকার রক্ষা করে। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে, বিরোধ নিষ্পত্তি করতে এবং সাংবিধানিক আদেশ রক্ষা করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, অনেক উন্নয়নশীল দেশের মতো, বাংলাদেশও এমন কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি, যা বিচার ব্যবস্থার কার্যকারিতা বাধাগ্রস্ত করছে। ভারতের বিচার ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের সীমাবদ্ধতা এবং সমাধানের উপায়গুলো স্পষ্ট হয়।
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার সংক্ষিপ্ত বিবরণ
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা কমন ল অঙ্গীকারের ওপর ভিত্তি করে গঠিত এবং এটি দুই স্তরে বিভক্ত:
১. নিম্ন আদালত (আধীনস্ত আদালত) : এখানে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলাগুলোর প্রাথমিক নিষ্পত্তি হয়।
২. উচ্চ আদালত : এখানে সুপ্রিম কোর্ট রয়েছে, যা আপিল বিভাগ এবং হাইকোর্ট বিভাগে বিভক্ত। এটি সংবিধান ব্যাখ্যা এবং নিম্ন আদালত তত্ত্বাবধান করার ক্ষমতা রাখে। যদিও সংবিধান বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে, বাস্তবে এটি প্রায়ই বাহ্যিক চাপ, প্রশাসনিক বাধা এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতার শিকার।
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা
১. মামলার জট :
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো মামলার বিশাল জট। লক্ষাধিক মামলা বছরের পর বছর ধরে নিষ্পত্তিহীন থেকে যায়। বিচারকের অভাব, দুর্বল অবকাঠামো এবং সম্পদের স্বল্পতা এই সমস্যাকে আরও প্রকট করে তোলে।
২. বিচারিক স্বাধীনতার অভাব :
যদিও সংবিধান বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে, বিচারকদের নিয়োগ এবং পদোন্নতিতে রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এটি জনগণের আস্থা ক্ষুণ্ন করে।
৩. দুর্নীতি :
বিচারিক প্রক্রিয়ার মধ্যে ঘুষ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারসহ দুর্নীতির ঘটনা ন্যায়বিচার প্রদান বাধাগ্রস্ত করে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে এটি প্রায়ই অধিগম্য নয়।
৪.অপর্যাপ্ত অবকাঠামো :
বাংলাদেশের আদালতগুলো প্রায়ই জনাকীর্ণ এবং আধুনিক প্রযুক্তির অভাবে কার্যক্রম ধীরগতিতে পরিচালিত হয়। বিচারিক সেবার ডিজিটালাইজেশন এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।
৫.ভবিচারক নিয়োগে বিলম্ব : জনসংখ্যার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা অনেক কম। বিচারকের নিয়োগে দেরি হওয়ার কারণে মামলার জট আরও বাড়ে এবং বিচার ব্যবস্থার দক্ষতা কমে।
৬. আইনি সহায়তার অভাব :
সরকার বিনামূল্যে আইনি সহায়তা দিলেও, অনেক প্রান্তিক জনগোষ্ঠী তাদের অধিকার সম্পর্কে অবগত নয়। এছাড়া আইনি সহায়তা ব্যবস্থাও অপ্রতুল এবং দুর্বলভাবে সংগঠিত।
ভারতের সঙ্গে তুলনা :
ভারত ও বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা কমন ল ভিত্তিক এবং তিন স্তরে বিভক্ত: নিম্ন আদালত, হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট। একই রকম চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও ভারত কিছু ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে, যা বাংলাদেশে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
১. মামলার জট : বাংলাদেশ ও ভারতের উভয় দেশেই মামলার জট অন্যতম বড় সমস্যা। তবে, ভারত ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট, লোক আদালত** এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি (ADR) পদ্ধতি চালু করে মামলার নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করেছে। বাংলাদেশেও সম্প্রতি ADR প্রক্রিয়া চালু হয়েছে, তবে তার কার্যকর বাস্তবায়ন এখনও সীমিত।
২. বিচারক নিয়োগ :
ভারতে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য কলেজিয়াম সিস্টেম চালু রয়েছে, যা তুলনামূলকভাবে বেশি স্বচ্ছ। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার নিয়োগ প্রক্রিয়া নির্বাহী শাখা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে প্রভাবিত করে।
৩. প্রযুক্তির ব্যবহার :
ভারত **ই-কোর্ট প্রকল্প চালু করে বিচার ব্যবস্থায় ভার্চুয়াল শুনানি, অনলাইন কেস ট্র্যাকিং এবং মামলা দায়েরের সুযোগ তৈরি করেছে। বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রয়োগ শুরু হয়েছে, তবে তা এখনো নগর এলাকায় সীমাবদ্ধ।
৪.দুর্নীতি ও জবাবদিহিতা :
উভয় দেশের বিচার ব্যবস্থায় দুর্নীতি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে, ভারতের বিচার বিভাগ **পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন (PIL) এবং অভ্যন্তরীণ তদারকি ব্যবস্থা চালু করেছে। বাংলাদেশেও বিচার ব্যবস্থার স্বচ্ছতা বাড়াতে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে।
৫.জনসচেতনতা এবং প্রবেশগম্যতা : ভারত ব্যাপক আইনগত সচেতনতা কর্মসূচি পরিচালনা করেছে, যা জনগণকে তাদের অধিকার সম্পর্কে অবগত করতে ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশে এ ধরনের উদ্যোগ তুলনামূলকভাবে কম।
বাংলাদেশের জন্য করণীয়
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা দূর করতে একটি সার্বিক সংস্কার অত্যন্ত প্রয়োজন:
১. বিচার বিভাগে সম্পদ বৃদ্ধি :
আরও বেশি বিচারক নিয়োগ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং পর্যাপ্ত তহবিল নিশ্চিত করা জরুরি।
২. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা শক্তিশালী করা :
বিচারক নিয়োগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ কমাতে হবে।
৩. ADR প্রক্রিয়া প্রসারিত করা :
ADR পদ্ধতির ব্যবহার বাড়িয়ে মামলা নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করা সম্ভব।
৪. ডিজিটাল রূপান্তর :
মামলা ব্যবস্থাপনা, অনলাইন দাখিল এবং ভার্চুয়াল শুনানির মাধ্যমে বিচারিক কার্যক্রমে আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করতে হবে।
৫.জনসচেতনতা প্রচারণা :
নাগরিকদের আইনি অধিকার এবং সেবা সম্পর্কে সচেতন করতে প্রচারণা চালানো উচিত। উপসংহার বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থা বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে রয়েছে। যদিও এর সীমাবদ্ধতা গুরুতর, তবে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। ভারতীয় অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং লক্ষ্যভিত্তিক সংস্কার প্রয়োগের মাধ্যমে, বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী ও কার্যকর বিচার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। একটি কার্যকর বিচার ব্যবস্থা কেবল গণতন্ত্রের ভিত্তি নয়, এটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নেরও মাইলফলক।
লেখক: আবরিন শাদ
ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি
আইন বিভাগ