সংবাদ শিরোনাম: |
দেশের ডাক্তার, নার্স ও দালালদের দৌরাত্ম্যে জিম্মি হয়ে পড়েছে সরকারি হাসপাতালের রোগীরা। এমন পরিস্থিতে হাসপাতালগুলোতে আসা রোগীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয় প্রতিনিয়ত। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার নামে চলমান নৈরাজ্য ও নির্মমতা দেখার যেন কেউ নেই। দেশের ৬৪টি জেলা শহরের বেশিরভাগ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও জনবল নেই। আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ক্লিনিকগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। এসব হাসপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় এমবিবিএস চিকিৎসক নেই।
আবার কোনো কোনো হাসপাতালে একাধিক এমবিবিএস কর্মরত। যেখানে এমন ডাক্তারের স্বল্পতা সেখানে ডাক্তারের সহকারী ও ওয়ার্ড বয় জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ভরসা। হাসপাতালসমূহে শুধু ডাক্তার সংকট নয় বরং সিনিয়র স্টাফ নার্সসহ অন্যান্য বিভাগে লোকবলের চরম সংকট। জেলা সদর ও উপজেলার বেশিরভাগ হাসপাতালে এক্স-রে, মেশিন, ডেন্টাল যন্ত্রপাতি, প্যাথলজিস্ট যন্ত্রপাতি, আর্ট বিভাগের যন্ত্রপাতি ইত্যাদিসহ বহু নাম না জানা মূল্যবান চিকিৎসা সামগ্রী ব্যবহারের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার আশায় আগত সাধারণ মানুষ ওই সমস্ত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
বিভাগীয় শহরের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও বেহাল দশা। একটু ভালো আর বিনামূল্যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পেতে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বড় আশা নিয়ে দরিদ্র রোগীরা হাসপাতালে আসে। কিন্তু এখানে এসেই তাদের পড়তে হয় বিপাকে, নানা বিড়ম্বনায়। হাসপাতালের প্রবেশ গেট থেকে শুরু করে কেবিন, বেড পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এক শ্রেণির দালাল। নানা প্রলোভন, যেমন দ্রুত ডাক্তার সেবা পাইয়ে দেয়া, প্রয়োজনীয় ঔষধ, থাকার জন্য কেবিন ইত্যাদি দেখিয়ে তারা দরিদ্র ও সহজ সরল রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এক রকম সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে। বিষয়টা অনেকটা এমনই- আগে টাকা পরে চিকিৎসা সেবা। এদের খপ্পরে পরে অনেকেরই চিকিৎসা সেবা তো দূরের কথা উল্টো দ্বিগুণ অসুস্থ হয়ে কখনো হাসপাতালের বারান্দায়ও শুয়ে কাতরাতে দেখা যায়। ওই সব দালালই এই পর্ব শেষে আবার সরকারি মেডিকেলের কাজের হতাশাপূর্ণ বর্ণনা দিয়ে প্রাইভেট ডাক্তারদের কাছে চিকিৎসা নিতে উদ্বুদ্ধ করে।
রোববার(২৩ মার্চ) শের ই বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এক মাস বয়সী শিশু আহনাফ আদিলকে শিশু বহির্বিভাগে দেখাতে যান দৈনিক দেশের ডাক পত্রিকার নিজস্ব প্রতিবেদক।
এর আগে আহনাফ আদিল নিউনেটাল সেবসিসে আক্রান্ত হলে নবজাতক ইউনিটে ভর্তি করান। নবজাতক ইউনিটে শিশু আহনাফকে নিয়ে যাবার পর দেখা যায় সেখানে উপস্থিত কয়েকজন নার্স বসে আছেন, তাদের মধ্যে একজনকে দেখা গেলো স্মার্টফোনে গেমস খেলছেন।
অভিযোগ আছে নবজাতক ইউনিটের মতো খুবই সেনসিটিভ ওয়ার্ডে নার্স ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী ও নিরাপত্তা কর্মীদের অবহেলা এবং রোগীর স্বজনদের সাথে দুর্ব্যবহার নিয়মিত ঘটনা।
শিশুর অভিভাবকদের অভিযোগ নার্সদের বারবার ডাকলেও শিশুদের কাছে যায়না তারা। ইনজেকশন দেয়ার সময় শিশু নড়াচড়া করলে হাত মুখ চেপে ধরে পশু বলে সম্বোধন করার অভিযোগও আছে কিছু হিন্দু সেবিকার বিরুদ্ধে।
এছাড়াও সেখানে আট দিন ভর্তি থাকায় পুরো হাসপাতালের নোংরা পরিবেশ, অব্যবস্থাপনা ও নানা রকম অনিয়ম দেখা গেছে। একজনের ইনজেকশন অন্য শিশুকে ভুলে দিয়ে দেয়ার অভিযোগ আছে। অবশেষে ছাড়পত্র দিয়ে সাতদিন পর শিশু বহির্বিভাগে দেখা করতে বললেন নবজাতক ওয়ার্ডের ডাক্তার বি সি বিশ্বাস।
এরপর দশদিন পর রোববার শিশু বহির্বিভাগে টিকিট কেটে আবাসিক চিকিৎসক(আর পি) ডাক্তার নুরুল আলমের কক্ষে প্রবেশ করলে তিনি সিবিসি,সিএক্স (আর ও বুকের এক্সে করতে বলেন। কিন্তু কক্ষ থেকে বের হলে ডাক্তারের সহকারী একজন নারীকে ডেকে টেস্টগুলো করাতে বলেন।
ঐ নারী আমাকে জরাজীর্ণ একটি ক্লিনিকে নিয়ে যান বলেন এটা স্যারের(ডাক্তারের) ক্লিনিক। সেখানে গিয়ে চোখ ছানাবড়া অবস্থা আমার, টেস্টের ফি ধরা হয়েছে ১৫০০ টাকা। উপরে উঠে দেখি ছোট একটি ছেলে বাচ্চার ব্লাড নেয়ার জন্য বাচ্চাকে নিয়ে বসতে বললেন,আমি না বসেই সেখানে টেস্ট না করিয়ে হাসপাতালের প্যাথলজিতে যাই এবং সেখানেই টেস্টগুলো করায়।
ভুক্তভোগী সাংবাদিক বলেন, আমি যখন প্রথমে ব্লাডের টেস্ট নিয়ে ডাক্তারের কক্ষে যাবো তখন ডাক্তারের সহকারী আমাকে ও আমার স্ত্রীকে কক্ষে ডুকতে দিলেন না এবং দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। আমার তখন বুঝতে বাকি রইলো না নারী দালাল ঐ সহকারীকে এসে সবই বললেন।
যাক দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে যখন ডাক্তারের কক্ষে ডুকবো ঠিক ঐ মুহুর্তে সহকারী বলে উঠলেন ডাক্তার নেই, উনি বাইরে গেছেন। আমি বললাম রিপোর্ট দেখিয়ে আমার অনেক দূরে যেতে হবে।
এরপর দুপুর ১ টার দিকে যখন ডাক্তারের কক্ষে প্রবেশ করলাম তখন লম্বা ফর্সা এক ডাক্তার আমাকে রুম থেকে বেরিয়ে যেতে বলেন, দেখলাম ভদ্রলোক ডাক্তার মোবাইলে খেলা দেখছেন আর শিশুদের ঔষধের নাম লিখছেন। আমি আমার স্ত্রীকে বুঝিয়ে রুম থেকে বের হলাম।
পরে এক্সে রিপোর্ট না থাকায় উনি ঔষধের নাম না লিখে খুবই খারাপ ব্যবহার করে বের করে দিলেন, বললেন বেয়াদবি করো! সাতদিন হাসপাতালে আসবা। এভাবে একজন ডাক্তার শিশুদের ঔষধ লিখছেন আর মোবাইলে খেলা দেখছেন, এ বিষয়গুলো কিভাবে দেখছেন কর্তৃপক্ষ। এসব ডাক্তার হাসপাতালের জন্য বিষফোঁড়াও বটে। অতঃপর এক্সে করে যখন আবারও ফিরলাম তখন ডাক্তার নুরুল আলমের দেখা পেলাম।
উনি হাসপাতালের রিপোর্ট দেখে মনে হয়ে কষ্টই পেলেন, বললেন শেবাচিমে কি আগেই রিপোর্ট রেডি করা থাকে! তার কারণ হচ্ছে উনাদের পছন্দের ক্লিনিকে কেনো পরিক্ষা করালাম না।
অভিযোগ আছে, হাসপাতালে দালালরা সরকারি ডাক্তারদের দ্বারা নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রিত আর রোগী প্রতি এসব দালালদের ডাক্তাররা কমিশন দিয়ে থাকে। রোগী দেখার সময় দেখা যায় তাদের বিভিন্ন রকম মিটিং থাকে। দুপুরের খাবারের আগেই ডাক্তারসহ নার্সরা বিরতিতে চলে যায়। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরেও তাঁদের দেখা মেলে না।
ভুক্তভোগী রোগীদের অভিযোগ, ডাক্তাররা তাদের সরকারি কর্মক্ষেত্রের চেয়ে নিজের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানকেই বেশি প্রাধান্য দেন। আরও একটি উল্লেখযোগ্য চিত্র হচ্ছে, ডাক্তাররা কর্তব্যরত থাকা অবস্থায় বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের উপস্থিতি।
দামী গিফট কিংবা বড় ধরনের সুবিধা পাওয়ার আশায় অনেক সময় ওই সব প্রতিনিধির সাথে ডাক্তারদের গল্প ও আলাপ-চারিতায় মেতে উঠতে দেখা যায়। তাদের এই কার্যক্রমের মাধ্যমেও লাইনে অপেক্ষামান থাকা রোগীদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। ডাক্তারদের অবহেলা ও অনুপস্থিতির সুযোগে নার্স, ওয়ার্ড বয় ও আয়ারাই হয়ে উঠে সর্বেসর্বা। রোগী দেখা থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করছে অবলীলায়।
সুযোগ-সুবিধাহীন সরকারি হাসপাতালে একশ্রেণির ডাক্তার, নার্স, আয়া-কর্মচারীর চরম দুর্ব্যবহারের সামনে রোগীরা থাকছেন বড়ই অসহায়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীসহ অন্যান্য রোগীরা পর্যাপ্ত ঔষধ থাকা সত্তেও সঠিকভাবে ঔষধ পায় না। ডাক্তারদের লেখা স্লিপ নিয়ে ঔষধ আনতে গেলেই ২/১টা সস্তা ঔষধ দিয়ে বলা হয়, বাকীগুলো স্টোরে নেই তাই বাহির থেকে কিনতে হবে।
অথচ বাহিরের ফার্মেসীতে গেলেই দেখা যায় না পাওয়া ঔষধগুলো অগ্নিমূল্য। এতসব দামী ঔষধ তাহলে যায় কোথায়? দেশের বেশিরভাগ চিকিৎসকদের বাণিজ্যিক মন-মানসিকতার কবলে পড়ে সাধারণ মানুষ সরকারি চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না। এই সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশায় নিকটস্থ বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে সেবা নিতে গিয়েও সাধারণ রোগীরা পড়ে নতুন হতাশা ও যন্ত্রণায়।
উন্নত চিকিৎসার নামে চাকচিক্যময় ওই সব ক্লিনিকে ভালো চিকিৎসার নামে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য। সাধারণ রোগীরা চিকিৎসকদের নামী-দামী ডিগ্রি দেখে চিকিৎসা নিতে গিয়ে বিপাকে পড়ে। ডাক্তারদের অতিরিক্ত ফি, প্রয়োজনীয় ঔষধের সাথে অপ্রয়োজনীয় ঔষধ, ঊর্ধ্বমূল্যের টেস্ট ফি, বেড ভাড়া দিয়েই ধার দেনা করে আনা অসহায় রোগীদের পকেট খালি হচ্ছে।
এই সব চার্জ তারা নিজেদের খেয়াল খুশি মতই বাড়াচ্ছে। তাছাড়া রোগীকে দরকারি ও অদরকারি প্যাথলজি টেস্টের জন্য লম্বা স্লিপ দিয়ে মনোনীত ক্লিনিক কিংবা ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষা করার জন্য পরামর্শ দেয়। অন্য কোথাও থেকে করলে সেগুলো অগ্রহণযোগ্য হয়।
এখানেও রয়েছে কমিশন বাণিজ্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মনীতি আর হুঁশিয়ারির কোন কিছুতেই পরোয়া নেই হাসপাতালগুলোর। অভিজাত হাসপাতাল নামের চিকিৎসা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক কর্তৃপক্ষও অনেক বেশি প্রভাবশালী।
ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর তথ্যানুযায়ী জানা যায়, সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী ৩৫% দুর্নীতি হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে, ২৪.৯% জেনারেল হাসপাতালে ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০.৭%।
অথচ উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও রয়েছে উন্নত চিকিৎসা সেবা। বড় বড় ও জটিল রোগের অপারেশন করার মতো সরকারি ব্যবস্থা ও আধুনিক যন্ত্রপাতিও এদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে রয়েছে। তাহলে কেন রোগীরা এত সব চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে? বর্তমান সরকার চিকিৎসা সেবা ও খাতে অনেক বড় বাজেট রাখে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মেডিকেল কলেজ স্থাপন, হাসপাতালগুলোতে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, অসংখ্য ডাক্তার নিয়োগ ইত্যাদি কমবেশি সকল ব্যবস্থা থাকলেও সেই হিসেবে নেই চিকিৎসা সেবা। প্রতিনিয়তই দেখা যাচ্ছে, বারবার ডাক্তারদের অবহেলা, কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতির চিত্র দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। এজন্যই সাবেক পলাতক প্রধানমন্ত্রী এসব ডাক্তারদের চাকরি ছাড়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
সরকারি হাসপাতালে দালালদের উৎখাত ও ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে মনিটরিং সেল জোরদার করাসহ কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং পাশাপাশি ডাক্তাররা যেসব যৌক্তিক সমস্যায় জর্জরিত সেগুলোকেও আমলে নিতে হবে।
এছাড়া অন্যান্য আনুষঙ্গিক সমস্যাগুলোর সমাধানকল্পে দ্রুতই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার পথ সুগম হবে।আগে হাসপাতাল ও ডাক্তারদের চরম অব্যবস্থাপনার কারণে ভারতে চিকিৎসা নিতে যেতেন অনেকেই কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থানের পর সেটা যখন বন্ধ হয়ে যায় তখন কিন্তু মানুষ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নিচ্ছেন। আমাদের দেশের ডাক্তার ও স্বাস্থ্যসেবার সাথে যারাই জড়িত তারা যদি ভালো ব্যবহার করে আন্তরিকতার সাথে সেবা দেয় তাহলে দেশের মানুষ দেশেই চিকিৎসা সেবা নিবে অন্য কোনো দেশে যাবেনা।